কেমন আছেন?
ডা. এজাজুল ইসলাম : ভালো আছি। গাজীপুর চেম্বারে আছি। রোগী দেখার ফাঁকে একটু অবসর পেয়ে খেতে বসলাম।
খাবার শেষ করেন তাহলে, পরে কথা বলি।
ডা. এজাজুল ইসলাম : না না, কথা বলা যাবে। আমি সারা দিন রোগী দেখে, ১০ মিনিটের ছুটি নিয়ে এইমাত্র খেতে বসছি। সামনে ভাত, এক হাতে প্লেট, আরেক হাতে ফোনে কথা বলছি—যেহেতু শুরুতেই অভিনয়ের প্রশংসা করলেন ... সত্যি বলতে, অভিনেতা যদি প্রশংসা শোনে, এমনিতেই পেটটা ভরে যায়। মনে হচ্ছে, ক্ষুধাটা কমে গেল। কথা এখন বলাই যায়। তবে দুঃখটা কী জানেন?
কী দুঃখ বলেন তো শুনি?
ডা. এজাজুল ইসলাম : দুঃখটা হচ্ছে, হুমায়ূন (আহমেদ) স্যার চলে যাওয়ার পর, আমি সিনেপ্লেক্সের দর্শকের কাছে একেবারেই নাই। কোনো ভালো নাটক, ভালো সিনেমায়ও নাই। হুমায়ূন স্যারের মৃত্যুর পর অভিনয় করছি ঠিকই, কিন্তু কোনো বৈচিত্র্য নাই। একই রকম গল্প, একই সবকিছু। এ নিয়ে আমার প্রচণ্ড হতাশাও ছিল। ভালো কাজ করতে পারিনি। এর মধ্যে আমি যত নাটক আর সিনেমায় কাজ করেছি, কেউ ফোন করে বলেনি, আপনার অভিনীত চরিত্রটা ভালো হয়েছে। অভিনয় দুর্দান্ত ছিল। স্যার চলে যাওয়ার পর এই দুঃখ ছিল। ‘রাজকুমার’–এর পরিচালক হিমেল আশরাফের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই, কারণ তিনি আমাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নাই, দেখা নাই, সাক্ষাৎ নাই—তবে ছবি নিয়ে প্রথম কথা বলতে যেয়ে বুঝেছি, হুমায়ূন স্যারকে অনেক শ্রদ্ধা করেন, অনেক ভালোবাসেন। আর এই কারণে হয়তো স্যারের হাতে গড়া শিল্পীকে তিনি ব্রেকটা দিয়েছেন। এটা হয়তো তাঁর জন্য কিছু না, কিন্তু আমার জন্য অনেক কিছু। অনেক বছর পর দর্শকের প্রচুর ফোন পাচ্ছি। পরিচালক আর অভিনয়শিল্পীরাও ফোন করছেন। এ রকম ফোনকল পেতাম যখন হুমায়ূন স্যারের নাটক প্রচারিত হলে বা ছবি মুক্তি পেলে।
আপনার কথায় মনে হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর হিমেল আশরাফের ‘রাজকুমার’ আপনাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলল।
ডা. এজাজুল ইসলাম : অবশ্যই। ‘রাজকুমার’ টিমের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। হিমেল আশরাফ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন, এ জন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট হলেও তাঁর প্রতি অনেক শ্রদ্ধা, কারণ, হুমায়ূন স্যারকে অনেক শ্রদ্ধা করেন। আমি তো হারায়ে গেছিলাম। হিমেলই আমাকে অনেক দিন পর ‘রাজকুমার’ দিয়ে সব শ্রেণির দর্শকের কাছে নিয়ে এসেছেন। আমার একটা বদভ্যাস, গড়পড়তা কাজ সব সময় ফিরায়ে দেই। আজও দিয়েছি একটা সিরিয়াল। গতকালও দিয়েছি। যেসব কাজ রানিং করছি, সেগুলোও করতে ইচ্ছা করে না। তৃপ্তি না নিয়ে আর কত কাজ করব! পারা যায় না তো। যেটা হয়, যাই, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়—ওইটাই ভালো লাগা। কিন্তু অভিনয় করে ভালো লাগা হুমায়ূন স্যারের পর ‘রাজকুমার’–এ পেয়েছি। পরিচালকেরও সেই বিশ্বাস ছিল যে হুমায়ূন আহমেদের শিল্পী, তিনিই চরিত্রটার প্রতি সুবিচার করতে পারবেন।
‘সিগন্যাল ভাই’ চরিত্রের প্রস্তাব প্রথম কীভাবে এসেছিল আপনার কাছে?
ডা. এজাজুল ইসলাম : পরিচালক হিমেল আশরাফের সহকারী অভ্র মাহমুদ ফোন করে এ রকম একটা চরিত্রের কথা বলল। শুনেই আমার বেশ ভালো লাগে। মনে হয়েছে, অনেক ভালো একটা চরিত্র হবে। তারপর বললাম, করব তো। এরপর বলল, যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ দিন শুটিং কিন্তু। আমি ভাবলাম, হুমায়ূন স্যারের মৃত্যুর পর অনেক বছর তো চেম্বারও মিস দেই না। এ রকম একটা চরিত্রের জন্য ১৫-২০ দিন সময় বের করাই যায়। চরিত্রটা আমাকে মুগ্ধ করে। এরপর একদিন পরিচালকের সঙ্গে দেখা, তাঁর অফিসে। আড্ডা দিলাম। প্রথম দিনই তাঁর ভাবনাচিন্তায় মুগ্ধ হলাম। হুমায়ূন স্যারের গুণগান শুরু করলেন, এর পর থেকেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও অব্যাহত। তারপর আমাকে পুরো গল্প আর চরিত্রটা শোনালেন। গল্প শুনেই বলেছি, ‘রাজকুমার’ ছবিটি দর্শক দেখবেনই। সেদিন যে তাঁকে খুশি করে বলি নাই, এটা আজ প্রমাণিত। দর্শক তো সিনেপ্লেক্সে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। তিন সপ্তাহ চলছে, শুনেছি এখনো হাউসফুল যাচ্ছে।
এই চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে কতটা এগিয়ে নিতে পেরেছেন বলে মনে করছেন?
ডা. এজাজুল ইসলাম : আমার মনে হয়, ‘রাজকুমার’ দিয়ে আবার অভিনয়ে প্রাণ পেলাম। করার পরও ভাবছিলাম, সারা দেশ ও সারা পৃথিবীর মানুষ ছবিটা দেখে বলবে, ও, এ তো বাঁইচা আছে এখনো, মরে নাই তো। অনেকেই ভাবছিলেন, আমি মারাই গেছি। শুনতে অন্য রকম মনে হলোও, অবস্থাটা তেমনই। যে বাঙালি কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইউকে ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন, তাঁদের সঙ্গে তো আমার দেখা হয় না। তাঁরা তো বাংলাদেশের এসব সিরিয়াল দেখেনও না। এমনটা ভাবতেই পারেন, মারাই গেছি। শুটিংয়ের সময় ও এরপর আমি অনেককে বলেছি, এই ছবি মুক্তি পর ওই সব দেশের বাঙালিরা বলবেন, আরে এই ব্যাটা তো মরে নাই, এই ব্যাটা তো বাঁইচা আছে। (হাসি)।
বলছিলেন, ছবিটি মুক্তির পর অনেকেই ফোন করছেন। ফোনে তাঁদের কাছ থেকে কোন কথাটা বেশি শুনতে হচ্ছে?
ডা. এজাজুল ইসলাম : সবাই বলছেন, এত পরিমিত অভিনয় করছেন, পরিশীলিত অভিনয় করেছেন এবং রিয়েল কমেডিটা করার চেষ্টাও করেছেন। আমরা তো কমেডিটা ঠিকমতো করতে পারি না—ভাঁড়ামি হয়ে যায়, অতি অভিনয়ের দিকে চলে যায়। পরিমিত, পরিশীলিত কমেডি কিন্তু হয়ই না। একজন পরিচালকও বোঝেন না, হোয়াট ইজ কমেডি। সবাই ভাবেন যে কমেডি মানে জোকারি। কমেডি মানে ভাঁড়ামি। কমেডিয়ান মানে হচ্ছে জোকার। আসলে কমেডিয়ান যে গ্রেট অ্যাক্টর, সে যে জোকার না, ভাঁড় না, এটা অনেকেই বোঝেন না। হিমেল আশরাফ একটা বাচ্চা ছেলে, কিন্তু তাঁর যে পরিমিতিবোধ, তার যে দুর্দান্ত কমেডি লেখার দক্ষতা, ‘রাজকুমার’–এ অভিনয় করে আমি জীবন ফিরে পেয়েছি আবার। এমন কথাও শুনছি। আমিও এটা মানছি।
নতুন কোনো ছবিতে কাজ করছেন?
ডা. এজাজুল ইসলাম : নতুন ছবির কাজ করছি না। সেদিন ‘রাজকুমার’ দেখা শেষে আমার অভিনয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, অনিমেষ আইচদা বললেন, নভেম্বরে একটা ছবির শুটিং করবেন। আমার জন্য একটা চরিত্র রাখবেন। তাঁর সেই ছবি অবশ্যই করব।
আপনি তো ব্যস্ত চিকিৎসক। এরপরও অভিনয়ের জন্য যে সময় বের করেন, তা কোন তাগিদ থেকে?
ডা. এজাজুল ইসলাম : এটা পুরোপুরি শান্তি থেকে। আমি অভিনয় করে শান্তি পাই। রোগী দেখেও শান্তি পাই। আরেকটা কাজ করে শান্তি পাই, তা হচ্ছে সংসার। বাসায় যখন বউ–বাচ্চাদের কাছে ফিরি, তাদের সঙ্গে কথা বলি, অন্য রকম শান্তি কাজ করে। এই তিন মিলিয়ে আমার জীবন। তিনটাতেই আল্লাহপাক আমাকে এখনো শান্তিতে রেখেছেন। অভিনয়ে তো আমি মরে গিয়েছিলাম, হিমেল আশরাফের উছিলায় আল্লাহপাক আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছেন।
‘রাজকুমার’ কি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছেন?
ডা. এজাজুল ইসলাম : এখনো দেখিনি। যেভাবে সবার কাছ থেকে শুনেছি, মনে হচ্ছে এখন যদি হলে যাই, তাহলে অন্যান্য দর্শকের ডিস্টার্ব হবে। মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখতে পারবেন না। দেখা যাবে, আমাকে দেখে দর্শকেরা ছুটে আসবেন, মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখার যাঁদের ইচ্ছা, তা তাঁরা পারবেন না। তাই ভেবেছি, ছবিটি দেখব, আরও কিছুদিন দর্শকেরা নির্বিঘ্নে দেখুক, তারপর। আমার পরিবারের মধ্যে বড় মেয়ে অবশ্য ছবিটা দেখেছে।
দেখে কী বলেছে?
ডা. এজাজুল ইসলাম : আমার বড় মেয়ে তো চিকিৎসক। সে সাধারণত হুমায়ূন স্যারের কাজের বাইরে আমার অভিনয়ের প্রশংসা কখনোই করে না। ওরা কয়েকজন মিলে ‘রাজকুমার’ দেখেছে। দেখার পর এই প্রথম হুমায়ূন স্যারের বাইরে কোনো কাজের প্রশংসা করল। বলেছে, ‘“রাজকুমার”–এ তোমার অভিনয় ভালো হইছে।’
আপনার পরিবারের খবর বলুন।
ডা. এজাজুল ইসলাম : স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে আমার পরিবার। বড় মেয়ে তাসফিয়া এজাজ, ছোট মেয়ে তাসনুভা এজাজ। দুজনই চিকিৎসক। বড় ছেলে শাহ মোহাম্মদ আবদুর রাফেও চিকিৎসক। ছোট ছেলে শাহ মোহম্মদ আবু বাকার সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে এখন হাঙ্গেরির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছে। আর আমার স্ত্রী লুৎফুন নাহার সিদ্দিকা, গৃহিণী, আমাদের সবাইকে আগলে রেখেছে।